সে অনেক আগের কথা। তখনো রোজ ভোরে সূর্য পুবদিকে উঠত আর সন্ধ্যে হলে ক্লান্তিতে ঢলে পড়ত পশ্চিমে। দিনের প্রথম আলো যখন আলতো করে ছুঁয়ে যেত শিশিরের ঠোঁট, বাতাসে স্বপ্নমাখা টাটকা জীবনের শব্দে আড়মোড়া ভেঙে চোখ মেলত পৃথিবী আর দিনশেষে ডুবে যেত নিঃশব্দ অন্ধকারে। প্রতিটা দিন ছিলো আর সবদিনের মতোই। প্রতিটা রাত সেই একই রকম। কখনোসখনো কিছু ঝোড়ো মেঘ হয়ত বজ্রধ্বনিতে গর্জে উঠত অথবা নগণ্য কোনো নক্ষত্র ছিটকে পড়ত আকাশের কোনো প্রান্ত থেকে। কিংবা মঠের অদূরে একটা বাঘের দেখা পেয়ে কোনো সন্ন্যাসী ভয়ার্ত ফ্যাকাশে চেহারায় ছুটে যেত বাকিদের জানাতে। ব্যস, এটুকুই যা হেরফের। এরপর প্রতিটা দিন সেই একই রকম গৎবাঁধা, উত্তেজনাহীন রুটিনবন্দি।
সন্ন্যাসীদের দিন কাটত রোজকার কাজকর্ম আর পুজোঅর্চনা করে। আর তাদের গুরুদেব মগ্ন থাকতেন সঙ্গীতসাধনায়। গুরুদেবের এ এক ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা। তাঁর সুরের মূর্ছনায় মঠের সবচেয়ে বয়সি সন্ন্যাসীরা, যাঁদের শ্রবণশক্তি বয়সের ব্যস্তানুপাতে ক্ষীয়মান, তাঁরাও অশ্রুসংবরণ করতে পারতেন না। তাঁর যেকোনো কথা, তা হোক বৃক্ষ-বিহঙ্গ কি সাগর-পাহাড়ের মতো অতি সাধারণ চিরচেনা কোনো বিষয়ে, সবার আবেগকে তীব্রভাবে নাড়া দিত। তিনি তাঁর বাণীর জাদুতে হাসাতে, কাঁদাতে জানতেন। যখন তিনি ক্রোধে উন্মত্ত হতেন বা আনন্দে উদ্বেলিত হতেন অথবা দারুণ ভালো বা দারুণ মন্দ কিছুর বর্ণনা করতেন কী যেন এক আবেগী শক্তি ভর করত তাঁর উপর। তাঁর চেহারায় ঝলসে ওঠা আবেগের গভীরতা ছলকে উঠত তাঁর দুচোখে। বজ্রনির্ঘোষ কণ্ঠে তিনি যদি সাগরে ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতির নির্দেশও দিতেন, মন্ত্রমুগ্ধ সন্ন্যাসীরা হয়তবা সে আজ্ঞা পালনেও তিলমাত্র দ্বিধা করতেন না।
ঈশ্বর-স্বর্গ-মর্ত্যের স্তুতিবাক্যে সাজানো তাঁর কাব্য, কণ্ঠ ও সুর ছিলো সন্ন্যাসীদের আনন্দের উৎস। একঘেয়ে জীবনের ঘূর্ণাবর্তে গাছ, ফুল, শীত, বসন্তও পুরোনো হয়ে যেত। সাগরের গর্জন আর পাখির ডাকও ক্লান্তিকর মনে হতো কখনো কখনো। কিন্তু গুরুদেবের সুর কখনো পুরোনো হতো না। তাঁর সৃষ্টি ছিলো সন্ন্যাসীদের আত্মার সঞ্জীবনী শক্তি। প্রতি বেলা আহার্যের মতোই অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টির উৎস।
যুগের পর যুগ পেরিয়ে গেলো এভাবেই। বনের পশুপাখিরা এগিয়ে গেলো কয়েক প্রজন্ম। আর বাকিসব পুরোনোই রয়ে গেলো। একই রকম সব দিন আর একই রকম সব রাত ঘুরেফিরে কেটে গেলো ছক বেঁধে। লোকালয় তখনো বেশ দূরে। মঠ থেকে নিদেনপক্ষে সত্তর মাইল মরুপথ। জীবনের মায়া ত্যাগ করে, সংসারের সব বন্ধন ছিন্ন করে, নিরুদ্দেশে হারাবার উদ্দেশ্যেই যারা পা বাড়াত পথে, মরুভূমিতে পদধূলি পড়ত তাদেরই।
তাই সেদিন রাতে এক শহুরে ভোগীপুরুষ যখন কড়া নাড়লো মঠের দুয়ারে, সন্ন্যাসীদের বিস্ময়ের অন্ত রইলো না। প্রথমেই জলখাবার চাইলো সে। পূজো না করে, গুরুদেবের আশীর্বাদ না নিয়েই। খেতে খেতে শোনালো তার শিকারের গল্প। শিকারে বেরিয়ে একটু বেশিই মদ খেয়ে ফেলেছিলো সে। নেশার ঘোরে তাই পথ হারিয়ে ফেলেছিলো। আত্মার শুদ্ধিলাভের উদ্দেশ্যে তাকে মঠে যোগদানের আমন্ত্রণ জানালে তার সহাস্য উত্তর: “আমি আপনাদের সঙ্গলাভের যোগ্য নই!”
খাওয়াশেষে সন্ন্যাসীদের দিকে চেয়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে সে বলে উঠলো:
“আপনারা তো কিছুই করেন না দেখছি। নাওয়াখাওয়া ছাড়া আর তো কোনো কাজ নেই। এভাবেই কি আপনারা আত্মার শুদ্ধি অর্জন করেন? একবার ভেবে দেখুন, যে সময়ে আপনারা এখানে পানাহারে ব্যস্ত আর মোক্ষলাভের স্বপ্নে বিভোর, ঠিক সে সময়েই আপনার পড়শিরা পচেগলে নরকের পথে পা বাড়াচ্ছে। শহরে কী ঘটছে দেখে আসুন একবার! অভাবের তাড়নায় কেউ অনাহারে ধুঁকে ধুঁকে মরছে, আবার কেউ প্রাচুর্য্যের ভারে হাবুডুবু খেতে খেতে তলিয়ে যাচ্ছে গভীর অন্ধকারে। সত্য নেই, বিশ্বাস নেই কোথাও। কে এদের বাঁচাবে? পথ দেখাবে কে? আমার মতো পথভোলা মাতাল? আপনাদের বিনয়, বিশ্বাস আর প্রেম কি শুধু এই চারদেয়ালে অকর্মণ্য জীবনযাপনের জন্য?”
কথাগুলো উদ্ধত আর অচেনা ঠেকলেও গুরুদেবকে বেশ ভাবিয়ে তুললো। সন্ন্যাসীদের সাথে চোখাচোখি হতেই খানিকটা ইতস্তত করে তিনি বললেন:
“ভাইয়েরা আমার, এই লোক ঠিকই বলেছে। অসহায় মানুষেরা অজ্ঞতার কারণে অবিশ্বাস আর পাপের অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। আর আমরা নিশ্চিন্তে হাত গুটিয়ে বসে আছি। আমাদের কি উচিত নয় তাদেরকে ঈশ্বরের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া?”
পরদিন সকালে সন্ন্যাসীদের বিদায় জানিয়ে শহরের পথে পা বাড়ালেন গুরুদেব। মঠটা পড়ে রইলো সুরশূন্য হয়ে। বিষণ্ন একটি মাস কেটে গেলো। এরপর আরেক মাস। কিন্তু গুরুদেব ফিরে এলেন না। অবশেষে তিন মাস পরে তিনি উপস্থিত হলেন। উচ্ছ্বসিত সন্ন্যাসীরা ঘিরে ধরলেন তাঁকে। তাদের অনেক প্রশ্ন। অনেক কৌতূহল। কিন্তু সন্ন্যাসীদের উচ্ছ্বাস স্পর্শ করলো না গুরুদেবকে। তিনি নীরব কান্নায় ভেঙে পড়লেন। এ ক’মাসে যেন গুরুদেব অনেক বেশি বুড়িয়ে গেছেন, আরো শীর্ণকায় হয়েছেন। তাঁর চেহারায় ক্লান্তি, একটা অজানা দুঃখের প্রলেপ। তাঁর অশ্রুতে ক্ষোভের উত্তাপ।
তা দেখে সন্ন্যাসীরাও কেঁদে ফেললেন। জানতে চাইলেন তাঁর যন্ত্রণার উৎস কোথায়। গুরুদেব কিছুই বললেন না। নিঃশব্দে নিজের কুঠুরিতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। অনেক অনুনয়-বিনয় করে, তাঁর দুয়ারে কড়া নেড়েও কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। তিনি অন্নজল স্পর্শ করলেন না, নতুন কোনো সুর বাঁধলেন না। শুধু কাঁদলেন টানা সাতটি দিন। বাইরে থেকে শুধু শোনা গেলো তাঁর কান্নার ক্ষীণ শব্দ।
সাতদিন শেষে তিনি বেরুলেন। তাঁর চেহারায় যন্ত্রণা, ক্রোধ আর ঘৃণা। মঠের সব সন্ন্যাসীকে জড়ো করে শান্ত কণ্ঠে এবার তিনি বলতে শুরু করলেন সেই তিনটি মাসের কথা। যাবার পথের পাখির ঝাঁক আর নদীর গল্প বলার সময় তাঁর কণ্ঠে ছলকে উঠলো আনন্দ। তখন তিনি যেন এক যুদ্ধগামী সৈনিক যাঁর বুকভরা স্বপ্ন, যাঁর বিজয় সুনির্ধারিত। স্বপ্নকে সম্বল করে, মনে মনে কবিতা আর সুর ভাঁজতে ভাঁজতে একদিন তিনি পৌঁছে গেলেন তাঁর লক্ষ্যে।
এটুকু বলার পর তাঁর কণ্ঠ ভারী হয়ে এলো। শহরের কথা বলতে গিয়ে তাঁর চোখে ছলকে উঠলো বিতৃষ্ণা আর কষ্ট। সেখানে তিনি যা দেখেছেন তা কখনো দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেন নি। এই বয়সে এসে এতদিনে প্রথমবারের মতো তিনি শয়তানের শক্তি আর মানুষের অসহায়ত্ব উপলব্ধি করলেন। ভাগ্যের পরিহাসে তিনি সর্বপ্রথম পা রেখেছিলেন এক ঝাঁক পদস্খলিতের আড্ডায়। জনাপঞ্চাশেক ধনী সেখানে পানাহারে মত্ত। দারুণ স্বাধীনচেতা, প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী আর ভীষণ সুখী সেই লোকগুলো মদের নেশায় চুর হয়ে যা খুশি তা-ই বকে চলেছে। ঈশ্বরভক্তরা নাকি যতসব নচ্ছাড়ের দল। এই মাতালেরা কাউকে ভয় পায় না, ঈশ্বরকে নয়, শয়তানকেও নয়, এমনকি মৃত্যুকেও নয়। তারা রিপুতাড়িত; যা মন চায় তা-ই করে, বলে। তাদের হাতে গলিত সোনার মতো সুরা যার স্বাদ ও গন্ধে মত্ত মানুষগুলো বারেবারে ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছে পেয়ালায়। প্রতি চুমুকে এক অবর্ণনীয় নিষিদ্ধ আনন্দ ছলকে উঠছে তাদের চোখেমুখে।
গুরুদেব অশ্রুবিজড়িত কণ্ঠে বলে যেতে লাগলেন সেসব অনাচারের কথা। সেই উন্মত্ত আড্ডার মধ্যিখানে টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে এক অর্ধনগ্ন নারী। কী নিষ্ঠুর সুন্দর সেই রমণী! যেন এক যৌবনবতী, দুঃসাহসী সর্পদেবী। তার দীঘল চুল, বাদামি ত্বক, কালো চোখ, ভরাট ঠোঁট আর নির্লজ্জ হাসির ফাঁকে ঝকঝকে দাঁতের পাটি যেন অদম্য ঔদ্ধত্য নিয়ে বলছে: “এই যে আমায় দেখো!” রেশম আর জরির ভাঁজ থেকে বসন্তের অঙ্কুরোদ্গত নতুন ঘাসের মতো উঁকি দেয় তার খোলা কাঁধ। সে মদ খেলো, গান গাইলো আর নিজেকে সঁপে দিলো অচেনা পুরুষদের আলিঙ্গনে।
গুরুদেব ক্ষুব্ধ ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বলতে লাগলেন ঘোড়দৌড়, মোষের লড়াই, থিয়েটার আর সেসব স্টুডিওর কথা যেখানে নগ্ন নারীদের ছবি আঁকা হয়, মূর্তি গড়া হয়। আর সন্ন্যাসীরা হতবিহ্বল হয়ে শুনে গেলেন শহরের সেই দুঃসহ, দুঃসাহসী বর্ণনা।
শয়তানের তাবৎ কীর্তি আর ধ্বংসযজ্ঞের ভয়ংকর রমণীয় রূপের বর্ণনা শেষে শয়তানকে শাপশাপান্ত করে গুরুদেব নিজের কুঠুরিতে ফিরে গেলেন।
পরদিন সকালে কুঠুরি থেকে বেরুলেন তিনি। দেখলেন মঠ জনশূন্য।
সব সন্ন্যাসী মঠ ছেড়ে পালিয়ে গেছে শহরে।
14 comments:
thanks... that translation was quite fluent... translating Chekhov in most of the times is impossible... your simplicity seemed to have done the trick..
thanks, Zaki! glad to hear from you!
অনুবাদটা খুব ভাল হয়েছে রে।
সত্যি বলতে কী, একবারের জন্য মনেও হয়নি যে আমি কোন অনুদিত লেখা পড়ছি।
তোর আসলে এই লাইনে চোখ-কান বুঁজে কাজ করে যাওয়া উচিত।
ভাল থাকিস।
তোর আরো এমন চমৎকার অনুবাদ পড়ার আশায় রইলাম
থ্যাঙ্কস!
এটা আমার দ্বিতীয় অনুবাদ। এর আগেরটা এক ইন্ডিয়ান রাইটারের ছিলো। তাই পারিপার্শ্বিকতা আর ভাব প্রায় একই রকম ছিলো। এটা তো তা না। তাই কনফিডেন্ট ছিলাম না। :)
ক্রমহ্রস্বমান,অশ্রুসংবরণ -শব্দ দুটা চাইলে পাল্টাতে পারেন।
পড়তে খুব ভাল্লাগ্লো। অনুবাদ চালাতে থাকেন।
চেকভের ২০১টা গল্প পাবেন এখানে। ইচ্ছামতো অনুবাদ করতে থাকেন।
http://chekhov2.tripod.com/
দারুণ সুন্দর। খুব ভালো লাগলো। অনুবাদ মনে হয়নি একদম। অনুবাদ চলুক। অনেক ধন্যবাদ পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য...
একদম ঝরেঝরে,মৌলিক লেখা মনে হয়, অনুবাদ নয়। দারুণ, চালায়ে যাও অনুবাদ।
ভারি, এবং সুন্দর! আর, সব মিলিয়ে ... ... সব মিলিয়ে আবার আর কী হবে! ... ওই দু'টো মিলিয়ে ভারি সুন্দর! (চলুক)
সাবাশ! এবং ধন্যবাদ। :-)
তৃষিয়া, সুখপাঠ্য অনুবাদ। অনেক সময়ই সেটা খুব কঠিন, আড়ষ্ট হয়ে যায়, এক্ষেত্রে হয়নি :-)
স্নিগ্ধা
tothakothito russy taan nai...vallagse.
mustafiz
সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। কিছু শব্দ বদলে দিলাম। আরো কিছু বদলাতে হলে জানানোর অনুরোধ রইলো।
সুন্দর অনুবাদ। চেখভের গল্পের শক্তিটা টের পাওয়া যায়। অনুবাদের অনুবাদ হলেও তাঁর ভাষার মাধুর্যটাও টের পাওয়া যায়। এভাবে চালিয়ে যাও। ছোট গল্পে আগ্রহ থাকলে আলবার্তো মোরাভিয়ার গল্প অনুবাদের চেষ্টা করতে পারো।
খুব চমৎকার, নির্মল, ঝরঝরে অনুবাদ। তোর মৌলিক লেখাগুলো এমনিতেই সুন্দর। আর এই অনুবাদ পড়ে তো আরেকটা মৌলিক লেখাই মনে হলো। গল্পটা আগে পড়িনি কিন্তু কাহিনীটা শ্রুত ছিলো। তারপরও এক নিঃশ্বাসে পড়ে গেছি সাবলীলতার কারণে। গল্পের আসল টুইস্টটা শেষ লাইনে। তুই সে পর্যন্ত গল্পটা ধরে রাখতে পেরেছিস।
চালিয়ে যা। তোকে দিয়ে অনেককিছু হবে।
Post a Comment